অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা ও চাকরির অধিকার পুনর্বহাল সংক্রান্ত মামলা
মামলার তথ্য:
মামলা নম্বর: সিভিল পিটিশন ফর লিভ টু আপিল নম্বর ৩৫০/২০০৭
বাদী: খন্দকার জালালউদ্দিন
বিবাদী: মোস্ত. জামিলা খাতুন
বিচারক: মো. তফাজ্জল ইসলাম
আদালত: আপিল বিভাগ
রায় ঘোষণার তারিখ: ১৩ জুন, ২০০৮
উৎস: VI ADC (2009) 485
মামলার পটভূমি
মোসা. জামিলা খাতুন, ১৯৮৯ সালে দিশারী উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তার পেশাগত উন্নতির জন্য তিনি বিএড কোর্সে ভর্তি হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, যা একটি শিক্ষকের জন্য বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ হিসেবে বিবেচিত। বিএড কোর্সে ভর্তি হওয়ার জন্য তিনি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এবং ম্যানেজিং কমিটির কাছে মৌখিকভাবে অনুমতি চান। প্রধান শিক্ষক মৌখিকভাবে তার এই আবেদনে সম্মতি দেন। এরপর জামিলা খাতুন ময়মনসিংহের একটি বেসরকারি বিএড কলেজে ভর্তি হন।
জামিলা খাতুনের দাবি অনুযায়ী, তিনি তার স্কুলে দিনের ক্লাস পরিচালনার পাশাপাশি সন্ধ্যায় বিএড কোর্সে অংশগ্রহণ করতেন। এতে তার বিদ্যালয়ের শিক্ষাদানের কার্যক্রমে কোনো বিঘ্ন ঘটেনি। তবে, ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরে, বিএড কোর্সের অনুশীলন শিক্ষার (প্র্যাকটিস টিচিং) জন্য তাকে কিছু দিনের জন্য ছুটির প্রয়োজন হয়। এ সময় তিনি ছুটির জন্য লিখিত আবেদন করেন। তার আবেদন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অনুমোদন করেন, তবে তা বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির অনুমোদনের উপর নির্ভরশীল বলে উল্লেখ করা হয়।
পরবর্তী সময়ে, বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি তার এই ছুটি মঞ্জুর না করে, বরং তার অনুপস্থিতি নিয়ে অভিযোগ তোলে। অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে শোকজ নোটিশ পাঠানো হয়। শোকজ নোটিশের জবাব দেওয়ার পরও ম্যানেজিং কমিটি তার বক্তব্য আমলে না নিয়ে তাকে বিদ্যালয় থেকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৯৯ সালের ২৩ মার্চ তাকে বরখাস্তের নোটিশ প্রদান করা হয়, যা তিনি ৪ এপ্রিল হাতে পান।
জামিলা খাতুনের বক্তব্য অনুযায়ী, বরখাস্তের পুরো প্রক্রিয়ায় ম্যানেজিং কমিটি বিদ্যালয়ের নিয়ম ও শিক্ষা বোর্ডের বিধি লঙ্ঘন করে। তার ছুটির আবেদন নিয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তাকে জানানো হয়নি। বরখাস্তের আগে ম্যানেজিং কমিটি তাকে সঠিকভাবে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়নি।
তাই, তিনি বরখাস্তের আদেশকে অবৈধ, ষড়যন্ত্রমূলক এবং আইনগতভাবে অকার্যকর দাবি করে আদালতে মামলা করেন। মামলার মাধ্যমে তিনি তার চাকরি পুনর্বহাল এবং ম্যানেজিং কমিটিকে তার শিক্ষাদানের কাজে কোনো ধরনের বাধা না দেওয়ার জন্য অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আবেদন করেন।
এই মামলার মূল প্রশ্ন ছিল, একজন শিক্ষকের পেশাগত উন্নতির জন্য বিএড কোর্সে ভর্তি হওয়া এবং ছুটি নেওয়ার বিষয়ে বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির দায়িত্ব ও সীমারেখা। পাশাপাশি, বরখাস্তের প্রক্রিয়া বিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী সম্পন্ন হয়েছে কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন উত্থাপিত হয়।
সহকারী জজের আদেশ
মামলার প্রাথমিক ধাপে সহকারী জজ আদালত (মাকলা, শেরপুর) বাদী মোসা. জামিলা খাতুনের অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আবেদনটি প্রত্যাখ্যান করেন। আদালত উল্লেখ করেন যে, বাদীকে বরখাস্ত করার বিষয়টি বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির নিয়মতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের ওপর ভিত্তি করে এবং বাদী অভিযোগের পক্ষে শক্তিশালী প্রমাণ উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
আপিল আদালতের আদেশ
সহকারী জজের আদেশের বিরুদ্ধে বাদী মোসা. জামিলা খাতুন শেরপুর জেলার জেলা জজ বরাবর আপিল দায়ের করেন যা প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালতে শুনানি হয় (মিস. আপিল নং ২২, ১৯৯৯)। আপিল আদালত বাদীর আবেদন গ্রহণ করে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা প্রদান করেন।
এই আদেশে আপিল আদালত বাদীর পক্ষে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখেন এবং বলেন যে, মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বাদীকে তার দায়িত্ব থেকে বিরত রাখা যাবে না।
হাইকোর্টের আদেশ
শেরপুর জেলা আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে বিবাদী পক্ষ সিভিল রিভিশন (নং ৯৮৮, ২০০০) দায়ের করেন। ২৭ জুন ২০০৫ তারিখে হাইকোর্ট ডিভিশন রুল ডিসচার্জ করেন, অর্থাৎ হাইকোর্ট বাদীর পক্ষে আপিল আদালতের আদেশ বহাল রাখেন।
মামলার শুনানি শেষে হাইকোর্ট বিভাগ (সিভিল রিভিশন নং ৯৮৮, ২০০০) ২০০৫ সালের ২৭ জুন তারিখে যে রায় প্রদান করেছে, তা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই রায়ে, হাইকোর্ট বিভাগের মাননীয় বিচারক মামলার বিষয়টি অত্যন্ত গভীরভাবে পর্যালোচনা করেছেন এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ আইনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন, যা বাংলাদেশের চাকরি ও শিক্ষা আইনের প্রয়োগের জন্য দৃষ্টান্তমূলক হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিম্নে হাইকোর্ট বিভাগের রায় ও পর্যবেক্ষণ বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো:
হাইকোর্ট বিভাগের রায়:
হাইকোর্ট বিভাগের রায়টি মূলত নিম্ন আপিল আদালতের সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন করেছে এবং জামিলা খাতুনের পক্ষে সিদ্ধান্ত প্রদান করেছে।
১. অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আবেদন:
হাইকোর্ট বিভাগের রায়ে বলা হয়েছে যে, জামিলা খাতুনের পক্ষে একটি শক্তিশালী প্রাইমা ফেসি মামলা উপস্থাপন করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ম্যানেজিং কমিটির সিদ্ধান্ত, যা তাকে বরখাস্ত করেছে, তা যথাযথ নয়। আদালত বলেছেন, "এ ধরনের বিষয়ে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আবেদনটি যুক্তিযুক্ত এবং এটি মঞ্জুর করা উচিত"।
২. শিক্ষকদের পেশাগত উন্নতি:
হাইকোর্ট বিভাগে পর্যালোচনার পর বলা হয়, "বিএড কোর্সে ভর্তি হওয়া কোনো অপরাধ নয়, বরং এটি শিক্ষকের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি ও উন্নতির জন্য অত্যন্ত সহায়ক"। আদালত বলেছেন যে, শিক্ষক হিসেবে পেশাগতভাবে উন্নতি লাভ করার জন্য বিএড কোর্সে ভর্তি হওয়া শিক্ষকের অধিকার, এবং এই ধরনের উদ্যোগকে উৎসাহিত করা উচিত।
৩. ম্যানেজিং কমিটির আইনগত ত্রুটি:
হাইকোর্ট বিভাগের মাননীয় বিচারক বলেছেন যে, ম্যানেজিং কমিটি জামিলা খাতুনের ছুটির আবেদন মঞ্জুর বা প্রত্যাখ্যান করার বিষয়ে তাকে যথাযথভাবে অবহিত করেনি, এবং ম্যানেজিং কমিটি তার পক্ষ থেকে কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার পরও সেই সিদ্ধান্ত তাকে জানানো হয়নি। হাইকোর্ট বিভাগের পর্যবেক্ষণ ছিল যে, "এভাবে শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া আইনগতভাবে সঠিক নয়"।
৪. সিদ্ধান্তের কার্যকারিতা:
হাইকোর্ট বিভাগ আরো বলেছেন যে, বাদী (জামিলা খাতুন) একাধিক বার শোকজ নোটিশের জবাব দিয়েছেন, তবে ম্যানেজিং কমিটি তার উত্তরকে উপেক্ষা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই বিষয়টি আইনগতভাবে অবৈধ বলে হাইকোর্ট বিভাগ মন্তব্য করেছেন।
৫. প্রতিস্থাপনযোগ্যতার বিষয়:
হাইকোর্ট বিভাগ রায়ে আরো উল্লেখ করেছেন যে, "এই ধরনের মামলায় অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা প্রদান না করার কোনো কারণ নেই, কারণ বাদীকে অনুপস্থিতির জন্য দোষারোপ করার সঠিক ভিত্তি প্রমাণিত হয়নি"।
আপিল বিভাগের রায়
আপিল বিভাগ হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন, এবং আদালত বলেছেন যে, হাইকোর্ট বিভাগের রায়টি সঠিকভাবে আইনগত বিশ্লেষণ করে এবং প্রতিষ্ঠানের বিধি-নিষেধের মধ্যে অবস্থিত বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন। আপিল বিভাগ রায়টির কোনও ভুল বা ত্রুটি খুঁজে পাননি এবং তারা হাইকোর্টের সিদ্ধান্তকে অপরিবর্তিত রেখেছেন।
উপসংহার
এই রায়টি আইনগতভাবে শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়ন এবং কর্মচারীদের অধিকার সংরক্ষণের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত প্রদান করে। এটি প্রতিষ্ঠিত করে যে, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষা গ্রহণের অধিকার অক্ষুণ্ণ রাখা উচিত এবং ম্যানেজিং কমিটির সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া সুষ্ঠু ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।