ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৬১এ ধারা: আপিল বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ রায় বিশ্লেষণ
এই লেখা থেকে যা জানতে পারবেন:
মামলার প্রেক্ষাপট
হাইকোর্ট ডিভিশনে মামলা খারিজের আবেদন
আপিল বিভাগে আবেদন
আপিল বিভাগের মূল্যায়ন: বিস্তারিত বিশ্লেষণ
হাইকোর্ট ডিভিশনে মামলা খারিজের আবেদন
আপিল বিভাগে আবেদন
আপিল বিভাগের মূল্যায়ন: বিস্তারিত বিশ্লেষণ
ভূমিকা
বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে ফৌজদারি কার্যবিধির বিভিন্ন ধারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষত, ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৬১এ ধারা আদালতকে একটি ব্যতিক্রমী ক্ষমতা প্রদান করে, যার মাধ্যমে কোনো মামলার কার্যক্রমকে বিচারাধীন পর্যায়ে খারিজ করা যেতে পারে। তবে এই ক্ষমতা প্রয়োগে সতর্কতা ও সীমাবদ্ধতা থাকা জরুরি, যাতে আদালতের প্রক্রিয়া অপব্যবহৃত না হয় এবং ন্যায়বিচারের স্বার্থ রক্ষা পায়।
সম্প্রতি ২০ এডিসি (২০২৩) ১৩০ নং রায়ে, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এই ধারা প্রয়োগ এবং এর সীমারেখা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন। এই মামলার বিচার কার্যক্রমে হাইকোর্ট ডিভিশন অভিযোগ ও সাক্ষ্যপ্রমাণ মূল্যায়ন করে মামলাটি খারিজ করে দেন। কিন্তু আপিল বিভাগ এই সিদ্ধান্তকে পুনর্বিবেচনা করে উল্লেখ করেন যে, বিচারাধীন মামলার প্রমাণাদি মূল্যায়ন করার এখতিয়ার কেবল ট্রাইব্যুনালের, যা হাইকোর্ট ডিভিশন অতিক্রম করেছেন।
এই প্রেক্ষাপটে, রায়টি বিচার প্রক্রিয়ার ন্যায়বিচার ও এর সীমাবদ্ধতার উপর আলোকপাত করে। এটি বিচার ব্যবস্থায় বিভিন্ন স্তরের আদালতের ভূমিকা এবং ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করার গুরুত্ব তুলে ধরে, যা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অপরিহার্য।
মামলার প্রেক্ষাপট
এই মামলাটি শুরু হয় ৩১ জুলাই, ২০১০ তারিখে বরিশালের কোতোয়ালি মডেল থানায় দায়ের করা একটি প্রাথমিক তথ্য প্রতিবেদন (FIR) এর মাধ্যমে। মামলার অভিযোগকারী, হাসিনা আক্তার, অভিযোগ করেন যে, আসামি কালাম মোল্লা ২০০৭ সাল থেকে তাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এই প্রতারণার ফলে হাসিনা গর্ভবতী হয়ে পড়েন।
গর্ভধারণের পরে, হাসিনা বিয়ের জন্য চাপ দিলে, কালাম বিভিন্ন অজুহাতে সময়ক্ষেপণ করতে থাকেন। অবশেষে, ৩০ জুলাই, ২০১০ তারিখে, কালাম মোল্লা হাসিনাকে নাথুল্লাবাদ বাস স্ট্যান্ডে* দেখা করার জন্য বলেন। সেখান থেকে তারা রয়েল হোটেলে যান এবং দুপুরের খাবার শেষ করে শাহনাজ কমপ্লেক্স, বরুড়া নামক একটি স্থানে একটি কক্ষে প্রবেশ করেন।
বন্দি করে রাখা এবং নির্যাতনের অভিযোগ
কক্ষে প্রবেশের কিছুক্ষণ পর, বাকি আসামিরা সেখানে উপস্থিত হন। অভিযোগ অনুযায়ী, আসামি সালিনা বেগম একটি ইনজেকশন প্রয়োগ করেন, এবং অন্যান্য আসামিরা আরও দুটি ইনজেকশন প্রয়োগ করেন। এতে হাসিনা শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন।
অভিযোগে আরও বলা হয়, এই সময়ে আসামি টুটুল হাসিনার ৮ আনার স্বর্ণের চেইন, যার মূল্য প্রায় ১৭,০০০ টাকা, ছিনিয়ে নেন। হাসিনা চিৎকার করলে স্থানীয়রা পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে হাসিনাকে উদ্ধার করে এবং আসামি সালিনাকে গ্রেফতার করে। বাকি আসামিরা পালিয়ে যায়।
মামলা দায়ের এবং চার্জশিট
ঘটনার পর ভুক্তভোগী তার পরিবারের সঙ্গে পরামর্শ করে কোতোয়ালি মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলাটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ধারা ৯(১) এবং পেনাল কোড এর ধারা ৩১৩, ৩২৩, ৩৪২, ৩৭৯ এবং ১১৪ এর অধীনে রুজু করা হয়।
পুলিশ তদন্ত শেষে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হওয়ায় চার্জশিট দাখিল করে। মামলাটি বিচারাধীন অবস্থায় নরী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল, বরিশাল-এ স্থানান্তরিত হয় এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন মামলা নং ৬৫৮/২০১০ হিসাবে নিবন্ধিত হয়।
হাইকোর্ট ডিভিশনে মামলা খারিজের আবেদন
বিচার চলাকালীন পর্যায়ে, আসামিরা ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৬১এ ধারার অধীনে হাইকোর্ট ডিভিশনে মামলা খারিজের আবেদন করেন। তারা দাবি করেন যে মামলাটি ভিত্তিহীন এবং বিচার চালিয়ে যাওয়া আদালতের প্রক্রিয়ার অপব্যবহার হবে। হাইকোর্ট ডিভিশন প্রাথমিক সাক্ষ্য এবং মেডিকেল রিপোর্টের ভিত্তিতে মামলা খারিজ করেন।
আপিল বিভাগে আবেদন
হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে, অভিযোগকারী হাসিনা আক্তার এবং রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে পৃথক ক্রিমিনাল পিটিশন দায়ের করেন। আপিল বিভাগ মামলার প্রেক্ষাপট এবং হাইকোর্টের রায়ের বিচার বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত প্রদান করেন।
আপিল বিভাগের মূল্যায়ন: বিস্তারিত বিশ্লেষণ
বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ হাইকোর্ট ডিভিশনের রায় পুনর্বিবেচনা করে গুরুত্বপূর্ণ কিছু আইনি নীতিমালা এবং বিচারিক প্রক্রিয়ার সীমাবদ্ধতা তুলে ধরেছেন। আপিল বিভাগ মূলত বিচারিক প্রক্রিয়ার যথাযথতা নিশ্চিত করার জন্য হাইকোর্ট ডিভিশনের রায় বাতিল করেছেন এবং নিম্ন আদালতকে মামলা পরিচালনার নির্দেশনা দিয়েছেন।
১. সাক্ষ্য-প্রমাণের বিচার করার এখতিয়ার
আপিল বিভাগ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় সাক্ষ্য-প্রমাণ মূল্যায়ন এবং বিচারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার নিম্ন আদালতের।
- ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮-এর ৫৬১এ ধারা হাইকোর্টকে মামলার প্রক্রিয়া বাতিল করার বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করলেও, এ ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। এটি কোনোভাবেই নিম্ন আদালতের বিচারিক এখতিয়ারকে লঙ্ঘন করার অনুমতি দেয় না।
- মামলাটি যখন প্রাথমিক পর্যায়ে থাকে বা বিচারাধীন থাকে, তখন হাইকোর্ট ডিভিশনের উচিত নয় কোনো সাক্ষ্যের ভিত্তিতে মামলাটি খারিজ করা।
২. ট্রায়াল চলমান অবস্থায় মামলা খারিজের সঠিকতা
আপিল বিভাগ তাদের রায়ে উল্লেখ করেছেন যে, হাইকোর্ট ডিভিশন মামলাটি অপরাধের প্রাথমিক সাক্ষ্য থাকা সত্ত্বেও খারিজ করেছেন।
- অভিযোগপত্র ও সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনাল একটি প্রাইমা ফেসি মামলা দেখতে পান, যা বিচার চালানোর জন্য যথেষ্ট ছিল।
- বিচার চলাকালীন মামলার প্রমাণসমূহ পুরোপুরি বিশ্লেষণ না করে শুধুমাত্র আংশিক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে মামলা খারিজ করা ন্যায়বিচার পরিপন্থী।
৩. বিচারিক প্রক্রিয়ার প্রতি সম্মান এবং আইনের প্রয়োগ
আপিল বিভাগ আরও উল্লেখ করেছেন যে, বিচারিক প্রক্রিয়া সঠিকভাবে অনুসরণ করা শুধু বিচারিক ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা বৃদ্ধি করে না, বরং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- হাইকোর্ট ডিভিশন যদি সাক্ষ্য ও প্রমাণের ভিত্তিতে মামলা বাতিল করেন তবে এটি বিচার ব্যবস্থার অপব্যবহার হিসাবে বিবেচিত হতে পারে।
- শুধুমাত্র সেই ক্ষেত্রে মামলাটি খারিজ হতে পারে, যখন প্রমাণিত হবে যে অভিযোগে কোনো অপরাধ গঠন করা হয়নি, বা মামলা আইনের দ্বারা নিষিদ্ধ, অথবা বিচারকের এখতিয়ার নেই।
৪. উচ্চ আদালতের সীমাবদ্ধতা
আপিল বিভাগ উল্লেখ করেছে যে, বিচারিক প্রক্রিয়া চলাকালীন, সাক্ষ্য-প্রমাণ মূল্যায়ন করার দায়িত্ব ট্রাইব্যুনালের। উচ্চ আদালত এই প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করলে, তা বিচারিক প্রক্রিয়ার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
- Golam Sarwar Hiru vs. The State এবং Habibur Rahman Mollah vs. The State মামলাগুলোর রেফারেন্সে বলা হয়, হাইকোর্ট ডিভিশনের উচিত ট্রায়ালের শেষ না হওয়া পর্যন্ত মামলা বাতিল না করা।
- আপিল বিভাগ নির্দেশ দেন যে, হাইকোর্ট কোনো পরিস্থিতিতেই নিম্ন আদালতের বিচারিক এখতিয়ার কেড়ে নিতে পারে না।
৫. মামলার পুনর্বিচার এবং নির্দেশনা
এই ক্ষেত্রে, আপিল বিভাগ হাইকোর্ট ডিভিশনের রায় বাতিল করেন এবং মামলাটি পুনরায় বিচারিক ট্রাইব্যুনালে পরিচালনার নির্দেশ দেন। ট্রাইব্যুনালকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে বিচার সম্পন্ন করতে বলা হয়।
৬. আইনের যথাযথ প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা
এই রায়ে আরও একবার নিশ্চিত করা হয়েছে যে, ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৬১এ ধারা যথাযথভাবে প্রয়োগ করা গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধু বিচার প্রক্রিয়াকে সুসংহত করে না, বরং বিচার বিভাগের স্বাধীনতাও বজায় রাখে।
উপসংহার
আপিল বিভাগের এই রায়টি বিচার বিভাগের ভূমিকা এবং সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে একটি স্পষ্ট দিকনির্দেশনা প্রদান করে। এটি প্রমাণ করে যে, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য বিচারিক প্রক্রিয়ার প্রতিটি স্তর গুরুত্বপূর্ণ এবং উচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপ যথাযথভাবে সীমাবদ্ধ হওয়া উচিত।